November 21, 2024, 8:49 am
ইমদাদুল হক, পাইকগাছা, খুলনা।।
জনবল সংকটের কারণে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে পাইকগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য সেবা। বর্তমানে ৫০ শয্যা হাসপাতালের ১৯০ জনবলের বিপরীতে শূন্য রয়েছে ৯০টি পদ। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক কাজ করেন অন্য জায়গায়। প্যাথলজি বিভাগ চালু থাকলেও নেই কোন টেকনিশিয়ান, এক্স-রে মেশিন নষ্ট, আল্ট্রাসনোগ্রাম কখনো করা হয়, কখনো করা হয় না। পরিচ্ছন্নকর্মী না থাকায় অপরিচ্ছন্ন এবং বাথরুমের দূর্গন্ধময় পরিবেশের মধ্যে সেবা নেন সাধারণ রোগীরা। জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে উন্নত সেবা দেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
উল্লেখ্য, জেলার সুন্দরবন সংলগ্ন গুরুত্বপূর্ণ উপকূলীয় এ উপজেলায় বর্তমানে ৩ লাখেরও অধিক মানুষের বসবাস। পাশাপাশি কয়েকটি উপজেলার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা অনেকটাই নির্ভর করে অত্র উপজেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপর। ১৯৯০ সালের দিকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির সকল কার্যক্রম সরল এলাকার ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হতো। ১৯৯৫ সালের দিকে পৌর সদরের ৬নং ওয়ার্ডের বাতিখালী মৌজায় ৫.৮০ একর সম্পত্তির উপর স্থান্তরিত করা হয়। ১৯৯৭ সালে ৩১ শয্যার হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। নতুন নতুন ভবন নির্মিত হলেও এখনো নানা সংকটে জর্জরিত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। পর্যাপ্ত আবাসিক ব্যবস্থা না থাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকের থাকতে হয় বাইরে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। রয়েছে তীব্র জনবল সংকট। ৫০ শয্যা হাসপাতালে ১৯০টি পদের বিপরীতে কর্তরত রয়েছে ১০০টি পদ। ৯০টি পদের নেই কোন জনবল।
হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন হাসপাতালের একমাত্র অবেদিনবিদ চিকিৎসক। ১১ জুনিয়র কনসালটেন্ট পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ২ জন চিকিৎসক। শূন্য রয়েছে ডেন্টাল সার্জনের পদ। মেডিকেল অফিসার ও সহকারী সার্জনের ৭ পদের বিপরীতে কর্মরত ৪ শূন্য রয়েছে ৩। মেডিকেল অফিসার ১জন কর্মরত রয়েছে। অন্যদিকে আবাসিক মেডিকেল অফিসারের পদ শূন্য রয়েছে। ৩২ জন সিনিয়র স্টার্ফ নার্সের বিপরীতে কর্মরত রয়েছে ২২ জন, শূন্য রয়েছে ১০টি পদ। মিড ওয়াইফ ৪টি পদে কর্মরত ৩, শূন্য ১। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ৫ পদের কর্মরত ১, শূন্য ৪। গুরুত্বপূর্ণ প্রধান সহকারীর পদটি শূন্য রয়েছে। উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারের ৪ পদে কর্মরত ২, শূন্য ২। ক্যাশিয়ার ও স্টোর কিপারের ২টি পদ শূন্য রয়েছে। সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে ১৩ জনের বিপরীতে ১২ জন কর্মরত রয়েছে, শূন্য রয়েছে ১টি পদ। ৪ স্বাস্থ্য পরিদর্শক পদে কর্মরত ১, শূন্য ৩টি পদ। ফার্মাসিস্ট ২ জনের বিপরীতে কর্মরত ১, শূন্য ১। কম্পিউটার অপারেটরের ১টি ও হেলথ এডুকেটর ১টি পদ শূন্য। প্রধান সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে ১ জন কর্মরত রয়েছে। পরিসংখ্যান বিদ ১টি ও ১টি সহকারী নার্সের পদ শূন্য রয়েছে। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ইপিআই পদে ১ জন এবং কার্ডিওগ্রাফার পদে ১ জন কর্মরত রয়েছে। কম্পাউন্ডারের ১টি পদ শূন্য রয়েছে। ১জন ড্রাইভার কর্মরত রয়েছে। স্বাস্থ্য সহকারীর ৬৫ পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছে ৪২, শূন্য রয়েছে ২৩টি পদ। হারবাল এসিট্যান্ড পদে ১জন কর্মরত রয়েছে। জুনিয়র ম্যাকানিকের পদ শূন্য রয়েছে। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটরের ৩টি পদে ২জন কর্মরত রয়েছে, শূন্য রয়েছে ১টি পদ। অফিস সহকারী কাম ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের ১টি পদ শূন্য রয়েছে। টিবি এন্ড ল্যাপরোসি কন্ট্রোল এসিট্যান্ড পদে ১ জন কর্মরত রয়েছে। ২টি সিকিউরিটি গার্ড ও ২টি আয়া পদ শূন্য রয়েছে। ২ জন কুকের স্থলে কর্মরত রয়েছে ১জন। মালি পদ শূন্য রয়েছে। অফিস সহায়ক ৪ জনের স্থলে কর্মরত ১, শূন্য রয়েছে ৩। ৫টি পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ৩টি ওয়ার্ড বয়ের পদ শূন্য রয়েছে।
এদিকে স্বল্প জনবল দিয়ে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে প্রতিদিন হিমশিম খেতে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। একদিকে জনবল সংকট, অপরদিকে ৪জন চিকিৎসক অত্র হাসপাতালের বেতনভাতা ভোগ করলেও প্রেশনে কর্মরত থাকেন ভিন্ন হাসপাতালে। প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি রোগী হিসেবে চিকিৎসাধীন থাকে ৭০ থেকে ৮০ জন রোগী।
প্রতিমাসে আড়াই’শ থেকে ৩শ গর্ভবতী নারী গর্ভকালীন সেবা নিয়ে থাকেন। রয়েছে জরুরী ও বহিঃ বিভাগ। সবমিলিয়েই জনবল সংকটের কারণে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্যসেবা। পাইকগাছা নাগরিক কমিটির সভাপতি মোস্তফা কামাল জাহাঙ্গীর জানান, স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর থাকলেও জনবল সংকটের কারণে পাইকগাছা উপজেলাবাসী কাঙ্খিত স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না। প্রতিবেশী দেশ ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক এগিয়ে গেলেও আমরা এখনো পিছিয়ে রয়েছি। আমাদের উপজেলা সহ পার্শ্ববর্তী উপজেলার কয়েক লক্ষ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নির্ভর করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপর। এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ধরণের ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ। হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগ চালু থাকলেও নেই কোন টেকনিশিয়ান। এক্স-রে মেশিনটি রয়েছে নষ্ট।
ফলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে এক্স-রে করতে গিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এমনটাই জানিয়েছেন ভুক্তভোগী মাসুম বিল্লাহ লাচ্চু। আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনটি কখনো ভালো থাকে, কখনো আবার খারাপ থাকে। এভাবেই চলছে আল্ট্রাসনোগ্রাম। পরিচ্ছন্নকর্মী না থাকায় বেশিরভাগ সময় অপরিচ্ছন্ন থাকে হাসপাতাল। বাথরুমের দুর্গন্ধে নিঃশ^াস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় ভর্তিকৃত রোগীদের। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনিমা বিশ্বাস জানান, হাসপাতালটি সব সময় নোংরা পরিবেশ থাকে। বাথরুমের গন্ধে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এভাবেই চলছে কয়েক লক্ষ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ সুজন কুমার সরকার জানান, নানা সংকটের মধ্যেও আমরা গর্ভবতী নারীদের গর্ভকালীন সেবা দিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশনা রয়েছে ৮৫ ভাগ নরমাল ডেলিভারী নিশ্চিত করা। এটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিশ্চিত করতে না পারলেও আমরা শতভাগ নিশ্চিত করছি। এটি আমাদের অনেক বড় সাফল্য।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ নীতিশ চন্দ্র গোলদার জানান, চরম জনবল সংকটের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা রয়েছে। কিন্তু স্বল্প জনবল দিয়ে জরুরী বিভাগ সহ সবখানে সেবা দেওয়া অনেক কঠিন। জনবলের অভাবে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে এটা যেমন সঠিক আবার স্বল্প জনবল নিয়ে এবং নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কয়েক লক্ষ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি এটিও ঠিক।
স্বাস্থ্য বিভাগের এ কর্মকর্তা বলেন, জনবল সংকটের বিষয়টি প্রতিমাসের মিটিং এ উত্থাপন করা সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১জনও পরিচ্ছন্নকর্মী নাই। আমরা কিছু পরিচ্ছন্নকর্মী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিয়েছি। যারা প্রতিদিন পরিচ্ছন্নকাজে নিয়োজিত থাকে। কিন্তু রোগী এবং তাদের স্বজনরা হাসপাতাল এবং হাসপাতালের বাথরুম যথাচ্ছো ব্যবহার করার ফলে বাথরুমগুলো নোংরা হয়ে যায়। এ কারণে বাথরুম পরিস্কার রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে যেমন পর্যাপ্ত জনবল প্রয়োজন তেমনি উন্নত পরিবেশ বজায় রাখতে হাসপাতালে আসা রোগী এবং আগত সকলের সচেতন হওয়া উচিৎ। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবেন এমনটাই প্রত্যাশা করেছেন এলাকাবাসী।